খামেনির পোষ্টার নিয়ে রাজ পথে ভারতের মুসলিমরা
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হতে পারে, এই আশঙ্কার মেঘ যখন ঘনিয়ে আসছে – তখন ভারতেরই একটি প্রত্যন্ত অংশে মানুষ কিন্তু প্রায় রোজ নিয়ম করে ইরানের সমর্থনে পথে নামছেন, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ্ খামেনির ছবি নিয়ে মিছিল করছেন কিংবা হেজবুল্লাহ-র হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন বিবিসি নিউ বাংলায় প্রতিবেদনে তুলে দরেন শুভজ্যোতি ঘোষ।
বিবিসি কিউজ বাংলা সাংবাদিক শুভজ্যেতি ঘোষ বলেন এতটাই, যে বাইরে থেকে এলে কেউ চট করে হয়তো বুঝতেই পারবেন না জায়গাটি ভারতে, না ইরানে!
সাধারণ গড়পড়তা ভারতীয়রা যখন ইসরায়েলের গোঁড়া সমর্থক বলে পরিচিত এবং ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও সংবাদমাধ্যমও লাগাতার ইসরায়েল-ঘেঁষা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে – তখন ভারতের এই প্রান্তটি কিন্তু গোটা দেশের মধ্যেই এক অদ্ভুত ব্যতিক্রম।
জায়গাটি আর কোথাও নয় – চীন ও পাকিস্তান সীমান্তঘেঁষা লাদাখের কার্গিলে, যা ঠিক ২৫ বছর আগের এক গ্রীষ্মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মারাত্মক লড়াইয়েরও সাক্ষী থেকেছে।
লাদাখের কার্গিল জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই শিয়া মুসলিম, আর ইরানের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও আত্মিক যোগাযোগও খুব গভীর।
ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে তারা যে ইরানের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছেন ও নিয়মিত সভা-সমাবেশ করছেন, তার একটা গভীর পটভূমি আছে।
বছরতিনেক আগে যখন কার্গিলে যাই, শহরের কেন্দ্রস্থলে ব্যস্ততম মোড়ের নাম যে ‘খামেনি চক’ – কিংবা সবচেয়ে বড় সমাবেশস্থলের নাম ‘হুসেইনি পার্ক’ – তা মোটেই নজর এড়ায়নি।
সে সময় ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা চলছিল জোর কদমে – এখন প্রয়াত ইব্রাহিম রাইসির বিরুদ্ধে সেই ভোট লড়ছিলেন মহসেন রেজি আর আবদোলনাসের হেম্মাতি।
মজার ব্যাপার হল, কার্গিল শহরের দেওয়াল পর্যন্ত তখন ছেয়ে ছিল ‘ফেভারিট’ রাইসির পোস্টারে।
এমন কী রেজি বা হেম্মাতিকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে দেওয়াল লিখন বা পোস্টারও চোখে পড়েছিল তখন, যা থেকে বোঝা যায় তারা ভোটার না হতে পারেন – কিন্তু সুদূর ইরানের নির্বাচনও কার্গিলে বিরাট বড় একটা ‘ক্রেজ’
হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হওয়ার পর কার্গিলে শোক আর ক্ষোভ
মাসকয়েক আগে সেই ইব্রাহিম রাইসি যখন হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হলেন, তাকে শেষ বিদায় জানাতেও কার্গিল চোখের জলে পথে নেমেছিল।
শোকের কালো পোশাক পরে হাজার হাজার শিয়া নারী-পুরুষ ‘লাবাইক ইয়া খামেনি’ ধ্বনিতে মুখর করে তুলেছিলেন শহরের আকাশ-বাতাস।
ভারতের অন্যত্রও প্রচুর শিয়া মুসলিম আছেন, বস্তুত ইরানের বাইরে বিশ্বের যে দেশে সবচেয়ে বেশি শিয়া বসবাস করেন সেটি হল ভারত।
সংখ্যায় তারা মোট তিন থেকে চার কোটির মতো হবেন বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু ভারতের লখনৌ বা হায়দ্রাবাদের মতো শহরগুলোতে যে শিয়ারা থাকেন তারা কার্গিলের শিয়াদের মতো এতটা সংঘবদ্ধ বা এককাট্টা নন – আর যে কোনও কারণেই হোক ইরানের সঙ্গে তারা সম্ভবত অতটা একাত্মতা বোধ করেন না, কিংবা থাকলেও তা দেখান না।
কিন্তু ইরান তথা ইরানের বিপ্লবের আদর্শের প্রতি সংহতি জানাতে কার্গিলের শিয়ারা কিন্তু কখনওই দ্বিধা বা সঙ্কোচে ভোগেনি – পাশাপাশি এটাও ঠিক, ভারতের প্রতি তাদের ‘দেশপ্রেম’ নিয়েও কেউ কখনও প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়নি।
বিগত কয়েক দশকে ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা, বাণিজ্যিক বা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা যত বেড়েছে, ততই ভারতের অধিকাংশ মানুষজন মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে খোলাখুলি ইসরায়েলকে সমর্থন জানাচ্ছেন – কিন্তু সেখানেও কার্গিল কিন্তু ইসরায়েলের বিরোধিতায় কখনও আপোষ করেনি।
প্রশ্নটা যখন ইসরায়েল বিরোধিতার, তখন শুধু ইরান নয় – তারা গাজার ফিলিস্তিনিদের হয়েও নিয়মিত পথে নেমেছেন, আওয়াজ তুলেছেন।